ফেরদৌস ওয়াহিদ : কোন জাতিই উন্নতির চরম শিখরে পৌছাতে পারেনা যদি সে তার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভুলে যায়। আমরা জাতিতে বাঙালী। আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে বিদেশী মিডিয়ার প্রভাবে আমরা আমাদের বাঙালী জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাঙালী সংস্কৃতিকে ভুলে বিদেশী সংস্কৃতির সাথে মিশে যাচ্ছি। আমাদের সমাজ জীবনে সংস্কৃতি পরিবর্তনে বিদেশী মিডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করছে ভারতীয় টিভি চ্যানেল। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যেভাবে আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করছে তা আমাদের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর দিক। এ চ্যানেলগুলো আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। আমাদের সংস্কৃতি ও ভারতীয়দের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তারপরও ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সংস্কৃতিকে প্রচার ও প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের সমাজে অপসংস্কৃতি হিসেবে প্রবেশ করে সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা তাদের সংস্কৃতির প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে টিভি সিরিয়াল ও নাটককে বেছে নিয়েছে। যার দ্বারা খুব সহজেই পরিবারের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সদস্য মহিলাদেরকে আকৃষ্ট করছে। যারফলে পরিবার ভাঙতে শুরু করেছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার ব্যবহার এতটাই আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে যে, মেয়ে পাখি জামা না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, স্ত্রী টিভি সিরিয়ালে দেখা সুন্দর একটি শাড়ি স্বামীর কাছে চেয়ে না পেয়ে স্বামীকে ডিভোর্স দিচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহের জাল বুনছে ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত টিভি সিরিয়ালগুলো। ফলে পরিবারের মধ্যে সর্বদা অশান্তি বিরাজ করছে এবং শেষ পর্যন্ত সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। বর্তমানে হিন্দী বলিউড সিনেমার নামে যে সকল অশ্লীল ছোট-খাট পোশাক পরিধান করা হচ্ছে তা আমাদের সংস্কৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমাদের সমাজের উঠতি বয়সের তরুন-তরুনী, যুবক-যুবতীরা বাঙালী জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভুলে অশ্লিল হিন্দী ফিল্মের প্রতি আসক্তি হয়ে নিজের লজ্জা-সরম জলাঞ্জলি দিয়ে প্রকাশ্য অশ্লিল বেহায়াপনায় লিপ্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পড়–য়া ছাত্রীরা বিদেশী সংস্কৃতিকে লালন করে ছোট, খাট পোশাক পরছে । এরফলে তারা শুধুমাত্র ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে তাই নয় বরং সমাজকে আবর্জনায় ফেলে দুর্গন্ধময় কলুষিত করছে। আবহমান গ্রাম বাংলার গ্রামীন জনপদের সাধারন মানুষের কথা যদি বলা হয় তাহলে দেখা যায় ভিনদেশী টিভি চ্যানেলগুলো দেখে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা, সম্মানবোধ ও সংস্কৃতিকে ভুলে কিভাবে তারাও এই ভিনদেশী সংস্কৃতির উপর প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। আগে দেখা যেত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মহিলারা কাজের ফাঁকে একটু সময় সুযোগ পেলে প্রতিবেশীর বাড়িতে যেয়ে বিভিন্ন খোজ খবর, দেখা সাক্ষাত করে আসত। বিকালে পাড়ার মহিলারা এক জায়গায় বসে এক অপরের খোজ খবর, সহমর্মিতা, সহযোগিতায় এগিয়ে এসে অবসর সময় কাটাতেন। তখন প্রায় সব পরিবারই একান্মবর্তী পরিবারের অর্ন্তভুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে দেখা যায়, গ্রাম বাংলার আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র অনেক পার্থক্য। বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে আজ গ্রাম বাংলায় একান্মবর্তী পরিবার খুবই কম দেখা যায়। মহিলারা এখন আর কাজের ফাঁকে প্রতিবেশীর বাড়িতে যেয়ে পারষ্পারিক খোজ খবর নেয়ার সময় পায়না। কিভাবেই বা সময় পাবে তারা যতটুকু সময় পায় ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে সময় কেটে যায়। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে গ্রাম বাংলার পরিবারে আজ সর্বদা কলহ লেগেই আছে। ভারতীয় টিভি সিরিয়াল এসব গ্রাম বাংলার মহিলাদেরকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে, পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না না করে টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বামী, সন্তান ও পরিবারের অন্যন্যা সদস্যদের প্রতি খেয়াল না করে তারা এই সংস্কৃতি নামক ভারতীয় অপসংস্কৃতির উপর ঝুকে পড়েছে। এই অপসংস্কৃতির প্রভাবে তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলে পোশাক পরিচ্ছদ ও ভাষা পাল্টাচ্ছে। কোমলমতি ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা ছোট থেকেই ভারতীয় হিন্দী ভাষায় প্রচারিত বিভিন্ন কার্টুন কমিকস দেখে বিনোদন উপভোগ করছে। যারফলে ঐ কোমলমতি ছোট শিশু সন্তান ছোট থেকেই হিন্দী ভাষা শিখছে এবং ঐসব অপসংস্কৃতি দেখে প্রভাবিত হচ্ছে। তাহলে একটু ভাবুন আমরা কী এইভাবে আমাদের বাঙালী সংস্কৃতিকে ভুলে বিদেশী অপসংস্কৃতি লালনের জন্যই কি ভাষা শহীদদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা পেয়েছিলাম? ৭১’ এর যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম?
