নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, নইলে পরে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’ এই বিখ্যাত উক্তিকে সামনে রেখে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের সরিষাডাঙ্গা গ্রামের আধ্যত্মিক সাধক বিশু শাহ্ এর ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও বার্ষিক ওরশ মোবারক ও তিন দিনব্যাপি বাউল মেলার উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার রাত ৯টার সময় এ মেলার উদ্বোধন করা হয়।
মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সরদার আল-আমিন ও প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন দৈনিক সময়ের সমীকরণ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রাজিব হাসান কচি, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সনি, বিশু শাহ মাজার কমিটির সভাপতি আব্দুস সালাম জোয়ার্দ্দার এবং মোস্তাফিজুর রহমান মাফি। অনুষ্ঠানটি সার্বিক পরিচালনা করেন দৈনিক সময়ের সমীকরণ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হুসাইন মালিক।
প্রধান অতিথি সরদার আল-আমিন তার বক্তব্যে বলেন, মানুষের চেতনায় মানবতাবোধ জাগ্রত করাই এই বাউল মেলার মূল লক্ষ্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য এই মেলা উন্মুক্ত। এছাড়াও এই বাউল মেলার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ভক্তবৃন্দ তাদের আত্মিক শুদ্ধির জন্য এ মেলায় আগমন করে।
প্রধান আলোচক নাজমুল হক স্বপন তার বক্তব্যে বলেন, সমগ্র বাংলাদেশকেই বলা যায় বৃহৎ এক মেলার দেশ। দেশের এমন কোনো জনপদ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে বছরের কোনো না কোনো সময়ে মেলা বসে না। বাঙ্গালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে খুঁজে পাওয়ার সব থেকে সহজ মাধ্যম হল গ্রামবাংলার বিভিন্ন লোকজ মেলা। বাউল মেলা সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপের অনুসন্ধান আর এটাই বাউল ধর্মদর্শনের প্রধান উৎসব।
বার্ষিক ওরশ মোবারক ও তিন দিনব্যাপি বাউল মেলা উপলক্ষে পুরো ইউনিয়ন জুড়ে ছিলো ভিন্ন আমেজ বিদ্যমান। মোমিনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে সরিষাডাঙ্গা বাউল মেলার প্রধান গেট পর্যন্ত সুন্দর আলোকসজ্জায় সজ্জ্বিত ছিলো। বাহারি রঙের আলোকসজ্জায় বাউল মেলার মঞ্চসহ আশপাশ এলাকা ছিলো সত্যিই দেখার মতো, যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে।
মেলার মূল আকর্ষণ ছিলো বাউল গানের আসর। সাইজি’র অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাউল ভক্তরা এসেছেন এ মেলায় কেউবা এসেছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। বিশু শাহ্ এর মাজারকে ঘিরে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি ঘরেই এই ৩দিন হবে তাদের আবাসস্থল। ওরশ মোবারক চলাকালীন এখানেই তারা অবস্থান করবেন। প্রতিবেলা সবার জন্যই রান্নার আয়োজন হয়। এ জন্য খাবার নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। বাউল ভক্ত নারী-পুরুষ ও অতিথিসহ সবাই একসঙ্গে বসে সেবা (খাবার) গ্রহণ করেন। এদিকে, বিশু শাহ্ এর মাজার প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায় ভক্তদের কেউ কেউ রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। বাউল সাধকরা নিজেদের সেবায়ক পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলেও তাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো।
এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জমে উঠেছে বিশাল মেলা। মেলায় বসেছে কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরি কুটির শিল্পসামগ্রী, মিষ্টির দোকানসহ নানা রকমারি পণ্যেরও দোকান। বাউল মেলার কদমা, মুরুলি, নিমকী, তীলের খাজা ও খেজুরের গুড়ের সন্দেশ ছিলো দর্শনার্থীদের মুখরোচক খাবার। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারতের কলকাতা থেকে ভক্তরা এখানে এসেছেন।
রয়েল কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী রানা আহমেদ ও খালেক শাহ্রে তত্ত্বাবধায়নে দেশ-বিদেশের বাউলদের গানে ও পূর্ণার্থীদের ভিড়ে মুখরিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বিশু শাহ্ এর ৮৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওরশ মোবারক ও বাউল মেলা। অনুষ্ঠিতব্য বাউল সম্প্রদায়ের এ মেলায় প্রতিবারের মতো এবারও যোগ দিচ্ছেন ভারত ও বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পী ও বাউলরা।
এ মেলার ইউতহাস সম্পর্কে যতোদূর জানা গেছে, বিশু শাহ্ ছিলেন আলমডাঙ্গা উপজেলার জাঁহাপুর গ্রামের মরহুম আরজান বিশ্বাসের ছেলে। জেলা সদরের কুতুবপুর ইউনিয়নের দত্তাইল গ্রামের মরহুম একিম শাহ্ এর শিষ্য ছিলেন তিনি। এরপর প্রায় ৪০ বছর তিনি সরিষাডাঙ্গায় অবস্থান করেছিলেন এবং নিজের আস্তানাও গড়ে তোলেন। বাংলা সাল অনুযায়ী তিনি ২০ ফাল্গুন ১৩৪৬ সালে ১০৫ বছর বয়সে গুরু একিম শাহ্ এর আস্তানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশু শাহ্ তার ভক্তদের কাছ থেকে জানা গেছে, তিনি মৃত্যুর আগে থেকেই বলে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর যেন সরিষাডাঙ্গায় তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। তার কথা মতোই তার ভক্তরা তার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তার মৃত্যুর দিনে আজকের এই বিশু শাহ্ এর মাজার ও বাৎসরিক ওরশ মোবারক।
